বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

স্বস্তি দিয়েছিল ট্রাম্পের বিদায় 

সেই তাকেই কেন ফেরালো জনগণ?

সুব্রত বিশ্বাস, কলামিস্ট

প্রকাশিত: ১৬:৪৭, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

সেই তাকেই কেন ফেরালো জনগণ?

ছবি: সংগৃহীত

শেষ পর্যন্ত ভোটে জিতে আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হলেন রক্ষণশীল রিপাবলিকান দলের অতি দক্ষিণপন্থী প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম দিকে সমানে সমানে টক্কর দিলেও শেষ পর্যন্ত ধরাশায়ী হলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী তথাকিথত লিবারেল কামালা হ্যারিস। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প শুধু পপুলার ভোট ও ইলেক্টোরাল কলেজ-উভয় ক্ষেত্রেই এগিয়ে থাকেননি, সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেন্টিটিভ অর্থাৎ সংসদের উভয় ক্ষেত্রেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। ফলে আগামী চার বছর সরকার চলাতে বা নিজের খুশি মতো নীতি গ্রহণ করতে কোনও বাধা থাকবে না। বিশে^র প্রায় সব দেশের রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর প্রবণতা, তখন আমেরিকা তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছে ৭৮ বছরের এক নেতাকে। শুধু বয়সের দিক থেকেই নয় নানা ক্ষেত্রে তার অনন্য নজির আছে। তিনি আমেরিকার প্রথম যিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে একবার হেরে যাবার পর দ্বিতীয়বার জয়ী হয়েছেন। 
 

তাছাড়া তিনিই সম্ভবত একমাত্র প্রেসিডেন্ট যার বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ ডলারের দুর্নীতি, হিংসায় মদত দেওয়া যৌন অপরাধ সহ ২৬টি গুরুতর মামলা চলছে বিভিন্ন আদালতে। তাকে গ্রেফতারও হতে হয়েছে। এমন এক নেতাকে আমেরিকার অধিকাংশ মানুষ যেমন পছন্দ করেছেন তেমনি কোনও মহিলা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হোক সেটাও চাননি। 
কোনও দেশের অভ্যন্তরীন নির্বাচন নিয়ে অন্যান্য দেশের মাথা ঘামানোর কথা নয়। কিন্তু দেশটা যেহেতু আমেরিকা তাই মাথা না ঘামিয়ে উপায় নেই। বিশে^র বৃহত্তম অর্থনীতির প্রতিটি পদক্ষেপের ধাক্কা যেমন বিশ^ অর্থনীতিতে অনিবার্য প্রভাব ফেলে তেমনি সামরিক-স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রে তাদের নীতি পরিবর্তন ও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। ইতিমধ্যে ক্ষমতায় এলে যা যা করবেন বলে ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন সেগুলো যদি বাস্তবায়ন হয় তাহলে বিশ^জুড়ে নতুন বিতর্ক, নতুন অস্তিরতা তৈরি হতে পারে। যেমন ট্রাম্প বিশ^াস করেন না বিশ^ উঞ্চায়ন ও তজ্জনিত পরিবেশের ভারসাম্যের পরিবর্তনে বৈজ্ঞানিক সত্যতায়। তাই দুষণ নিয়ন্ত্রণে আমেরিকা কোনো দায় নেবে না। তিনি এটাও মনে করেন উদার বাণিজ্যের জন্যই আমেরিকা পণ্য উৎপাদনে পিছিয়ে পড়েছে। মার্কিন শিল্প প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে কর্মসংস্থান ও মজুরি বৃদ্ধি করতে পারছে না। তাই মার্কিন বাজারে বিদেশী পণ্য আমদানি আটকাতে আমদানি শুল্ক ২০ থেকে ১০০ শতাংশ বাড়িয়ে দেবেন। তেমনি বাইরের যুদ্ধ সংঘাতে মার্কিন অস্ত্র ও অর্থ ব্যয় কমাবেন। বিনিময়ে অস্ত্র রপ্তানিতে জোর দেবেন। আর দেশের মধ্যে কর্পোরেশন কর যথাসম্ভব কমিয়ে কর্পোরেট মুনাফা সর্বোচ্চ করার ব্যবস্থা করবেন। 
যদি সত্যি সত্যি তিনি প্রতিশ্রুতি মতো পদক্ষেপ শুরু করেন তাহলে আমেরিকার অভ্যন্তরে যেমন বিতর্ক নৈরাজ্যের ঝড় উঠবে তেমনি বিশ^ অর্থনীতি ও বিশ^ বাণিজ্য ব্যবস্থাতেই প্রবল অস্থিরতা দেখা দেবে। শেষ পর্যন্ত তার পরিণতি কোন দিকে গড়াবে, কারা তার সুযোগ নেবে এবং কারা তার শিকার হবে তা বোঝা যাবে কিছুদিন পর থেকেই।
চার বছর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নেন, স্বস্তির নিশ^াস ফেলেছিল আমেরিকা। বলা হয়েছিল, বিভাজনের রাজনীতির পরাজয় হয়েছে। কিন্তু সেই ট্রাম্পই আবার ক্ষমতায় ফিরলেন হইহই করে। তিনি জিতেছেন আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার ভোটে। তবু, তিনি ফিরতে দেশটিতে ভয়ের পরিবেশ-ও ফিরেছে। অন্তত, এই ক’দিন আলাপ-আলোচনায় সেটাই বোঝা যাচ্ছে। 
এই উদ্বেগের কেন্দ্রে রয়েছে চরম রাজনৈতিক মেরুকরণ। গত কয়েক বছরে আমেরিকা রাজনৈতিকভাবে আরও বিভক্ত হয়েছে, উভয় পক্ষই একে-অপরকে দেশের জন্য বিপদ হিসাবে দেখছে। ট্রাম্পের অধীনে, এই বিভাজনগুলো আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল এবং আনেকেই মনে করছে তাঁর প্রত্যাবর্তন মেরুকরণের ধারাবাহিকতাকে অক্সিজেন যোগাবে। বিভিন্ন গবেষণা ও সমীক্ষায় ইঙ্গিত মেলে যে, মার্কিনরা ক্রমবর্ধমান মতাদর্শগত অক্ষে সংঘবদ্ধ হচ্ছে, যেখানে কেবল নিজের মতটি প্রধান্য পায়, বিরোধিতা বা বিপরীত দিকের দৃষ্টিভঙ্গিকে শত্রুতা হিসেবে দেগে দেওয়া হয়। অনেকেই আবার এই কারণে চিন্তিত যে, ট্রাম্পের ভাষণ ও কার্যকলাপ গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও দুর্বল করতে পারে। অনেকেই একে গণতন্ত্রের পক্ষে গুরুতর বিপদ হিসাবে দেখছে। 
চার বছর আগে তাঁর এই ভুল-এর জন্যই তাকে হারিয়ে জো বাইডেন ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু আমেরিকায় কি এমন ভাব-পরিবর্তন হল যে, সেই ট্রাম্পকেই দেশের মানুষ আবার ক্ষমতায় ফেরাল? বলা হয়, আমেরিকার কাছে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ ছিল ‘দুঃস্বপ্ন’। সেই জায়গা থেকে তাই তার হোয়াইট হাউসে ফেরা অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু ৭১ মিলিয়নেরও বেশি আমেরিকানের ভোটে জয়ী হয়েছেন ট্রাম্প। তিনি কেবলমাত্র ইলেক্টোরাল কলেজ-ই জেতেননি, পপুলার ভোটেও জিতেছেন। এমন কৃতিত্ব তিনি ২০১৬ বা ২০২০ সালেও দেখাতে পারেননি। তাঁর এই বিপুল জয়ের পরেও দেশের একাংশের মানুষের আশঙ্কা, হোয়াইট হাউসে ফিরলে প্রথাগত ভারসাম্যকে হ্রাস করতেই থাকবেন ট্রাম্প। 
ইতিমধ্যে মহাধনী প্রচারসঙ্গী এলন মাক্সের জন্য নতুন দপ্তর খুলে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোলান্ড ট্রাম্প। ‘টেসলা’ এবং ‘স্পেসএক্স’ প্রধানকে ‘সরকারী দক্ষতা’ নামে একটি দপ্তরে। 
আমেরিকার সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, নতুন দপ্তরটির কাজ হবে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে চালু বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ খারিজ করা। একচেটিয়া বহুজাতিকে ব্যবসায়িক সংস্থাগুলোর ওপর নজরদারির সুযোগও খারিজ করা। এই দপ্তরের কাজে মাক্সের ব্যবসায়িক যোগাযোগকে ব্যবহার করতে আগ্রহী প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচত ট্রাম্প। 
ট্রাম্প নির্বাচত হলেও এখনও দায়িত্ব নেননি। জয়ের পর গত বুধবার হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট বাইডেনর সাথে প্রথম সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। বাইডেন শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। তবে ট্রাম্প ইতিমধ্যে তার প্রধান সহযোগীদের বাছাই শুরু করে দিয়েছেন। আর তাতেই চাঞ্চল্য ছড়াচ্ছে যথেষ্টভাবে। ট্রাম্প যদিও বলেছেন, মাক্সের দপ্তরের কাজ হবে ‘সরকারের বাইরে থেকে পরামর্শ দেওয়া’। তবে তা কিভাবে সম্ভব হবে দেখা যাবে কাজ শুরু হলে। 
এলন মাস্ক সোশাল মিডিয়া টুইটারেরও মালিক। টুইটারকে মার্কিন নির্বাচনে ব্যাপক মাত্রায় ব্যবহার করা হয়েছে রিপাবলিকান প্রার্থীর প্রচারে। মাস্ককে সম্ভবত বিবেক রামস্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে নতুন দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হবে। 
অতি দক্ষিণপন্থীদের সমর্থক ফক্স নিউজের অ্যাঙ্কর পিট গেসেথকে ট্রাম্প বসাচ্ছেন প্রতিরক্ষা সচিবের পদে। এর আগে সাউথ ডাকেটার গভর্নর ক্রিস্টি নোয়েমকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে বসানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন। এই নোয়ামকে ঘিরে কিছুকাল আগে খবর হয় নিজের পোষা কুকুরকে গুলি করে মেরে ফেলার জন্য। নোয়াম নিজেই তা জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন যে কুকুরটিকে বাগ মানানো যাচ্ছিল না, অবাধ্য। তাই নিজেই গুলি করে মেরেছেন। তবে ভোটের আগে হইচই হওয়ায় ট্রাম্পের এই সহযোগী জানান যে বিষয়টি সম্পর্কে বহু ‘মিথ্যা সংবাদ’ পরিবেশন করা হয়েছে। এই ক্রিস্টি নোয়েমের হাতেই থাকবে অবৈধ ঘোষিত অভিবাসীদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার। সন্ত্রাসবাদ রোধ, সাইবার সুরক্ষার মতো বিষয়ও থাকবে নোয়ামের হাতেই। 
এর আগেই ইজরায়েলের রাষ্ট্রদূত পদে মাইক হাকাবিকে বেছে নিয়েছিলেন ট্রাম্প। এই হাকাবি একসময় বলতেন, ‘প্যালেস্তাইন বলেই কিছু নেই’। প্যালেস্টাইনের রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি তো দূর, ইজরায়েলের জায়নবাদী অতি দক্ষিণপন্থী  স্বরের প্রতিনিধি হাকাবি। কথায় আছে ভোরের আবহাওয়া দেখলে দিনটি কেমন যাবে বোঝা যায়, ইতিমধ্যে ট্রাম্পের নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নাম দেখে খুব একটা আশ^স্ত হবার মনে হচ্ছে না। 
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট ও সভাপতি, উদীচী যুক্তরাষ্ট্র।
 

শেয়ার করুন: