বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারি ২০২৫

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

পুড়েছে বাংলাদেশের পাঁচ মন্ত্রণালয়ের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি

সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ডে ‘ষড়যন্ত্রের’ গন্ধ!

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা

প্রকাশিত: ০১:৪৭, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ডে ‘ষড়যন্ত্রের’ গন্ধ!

ছবি: সংগৃহীত

ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়েছে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবন। এতে পুড়ে গেছে পাঁচ মন্ত্রণালয়ের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি। বাংলাদেশ সময় বুধবার দিবাগত রাত ১টা ৫২ মিনিটে ভবনটির ষষ্ঠ তলায় আগুনের সূত্রপাত। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট মিলে প্রায় ৬ ঘণ্টা পর সকাল ৮টা ৫ মিনিটে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে আগুন পুরোপুরি নির্বাপিত হতে বেলা ১১টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত সময় লেগে যায়। আগুন নেভাতে গিয়ে ট্রাকচাপায় নিহত হয়েছেন মো. সোহানুর জামান নয়ন নামে ফায়ার সার্ভিসের এক সদস্য।
মধ্যরাতের পর আকস্মিক এ আগুনে ভবনের ষষ্ঠ থেকে নবম পর্যন্ত চারটি তলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ চারটি তলায় থাকা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়; সড়ক পরিবহন ও সেতু, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র, কম্পিউটার ও আসবাব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। আগুনে মূলত ছয়, সাত ও আট তলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব তলার বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, কম্পিউটার, আসবাব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

সচিবালয় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর (কেপিআই) একটি। এখানে নজিরবিহীন এ ভয়াবহ আগুনের উৎস এখনো জানা যায়নি। তবে এ আগুনের পেছনে ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে করছেন উপদেষ্টা ও রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে গতকাল বৃহস্পতিবার একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সভায় ঘটনাটি তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবকে প্রধান করে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে সদস্য সচিব করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের প্রধানকে। এর আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। পরে ওই কমিটি বাতিল করা হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ও পৃথক কমিটি গঠন করেছে। ক্ষতি নিরূপণ করাই হবে এসব কমিটির মূল কাজ।
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে ইঙ্গিত করেছেন অন্তবর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। গতকাল বৃহস্পতিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে তিনি এ সম্পর্কিত এক পোস্টে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়ে হওয়া অর্থ লোপাট, দুর্নীতি নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল। আগুনে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এখনো জানা যায়নি। আমাদের ব্যর্থ করার এ ষড়যন্ত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকবে তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়া হবে না।’
একই ধরনের মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। গতকাল পঞ্চগড়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সচিবালয়ে যেভাবে আগুন লেগেছে এবং এটার ধরন, অবস্থান যেমন, তা কখনই সাধারণভাবে বা কোনো দুর্ঘটনাবশত আগুন হতে পারে না। আমরা আমাদের জায়গা থেকে মনে করি, ষড়যন্ত্র করে, পরিকল্পনা করে এ আগুন লাগানো হয়েছে।’
দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান। এ সময় তারা ভবনের ক্ষয়ক্ষতির বিষয় খোঁজখবর নেন। এ সময় নাশকতার চেষ্টায় আগুন দেয়া হয়েছে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, তদন্তের আগে এ প্রশ্নের জবাব দেয়া সম্ভব নয়।
ফায়ার সার্ভিসের ভাষ্যমতে, বুধবার দিবাগত রাত ১টা ৫২ মিনিটে সচিবালয়ের ওই ভবনে আগুন লাগার সংবাদ পাওয়া যায়। এর ২ মিনিট পর সচিবালয়ে অবস্থিত ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটটি আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করে। আগুনের তীব্রতা বাড়লে একে একে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট অগ্নিনির্বাপণ কাজে যোগ দেয়।
আগুন নেভানোর কাজ করতে গিয়ে ট্রাকচাপায় ফায়ার সার্ভিসের এক সদস্য নিহত হয়েছেন। তার নাম সোহানুর জামান নয়ন। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল ঘটনাস্থলে এক ব্রিফিংয়ে জানান, পানির পাম্প থেকে লাইনের সংযোগ দিতে সড়ক পার হওয়ার সময় ট্রাকের ধাক্কায় সোহানুজ্জামান নয়ন আহত হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর তাকে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার প্রাথমিক কারণ এখনো আমরা বের করতে পারিনি। আগুন নেভানোর পর আমরা সব জায়গা তল্লাশি করে আপনাদের বলতে পারব।’
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কারণ ও উৎস খুঁজে বের করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। আগামী তিনদিনের মধ্যে কমিটিকে প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে এক জরুরি বৈঠকে উচ্চ পর্যায়ের এ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। সদস্য হিসেবে থাকবেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব, পুলিশের আইজিপি, ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (সদস্য সচিব), সদস্য সশস্ত্র বাহিনীর একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েট থেকে তিনজন বিশেষজ্ঞ, একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘কমিটি অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও উৎস খুঁজে বের করে আগামী তিনদিনের মধ্যে একটি প্রাথমিক রিপোর্ট সরকারকে দেবে। প্রাথমিক প্রতিবেদনের বিষয়টি গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানানো না গেলেও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন গণমাধ্যমকে পুরোটাই জানানো হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব এ প্রতিবেদন দেয়া হবে।’
উচ্চ পর্যায়ের ওই তদন্ত কমিটি ছাড়াও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সাত সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করেছে। অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন) মোহাম্মদ খালেদ রহীমকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অফিস আদেশে বলা হয়েছে, সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের উৎস ও কারণ উদ্ঘাটন, পেছনে কারো ব্যক্তিগত বা পেশাগত দায় আছে কিনা তা উদ্ঘাটন এবং এ-জাতীয় দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তদন্ত কমিটিকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ ছাড়াও ঢাকা মহানগর পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের তদন্ত কমিটিতে রাখা হয়েছে।

শেয়ার করুন: