ছবি: সংগৃহীত
তখন আমার হাফপ্যান্ট পরার বয়স। সেদিন স্কুল বন্ধ ছিল কারণ ‘হ্যাঁ আর না’ ভোটের দিন ছিল সেদিন। বাংলাদেশ একজনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চায় কিনা, সেটার জন্য ভোট। মানুষ আগেভাগেই এই অদ্ভুত ধরনের ভোট প্রত্যাখ্যান করেছিল। উপরন্তু ধরেই নিয়েছিল ‘হ্যাঁ‘কে জয়যুক্ত করাই এই ভোটাভুটির হেতু।
আমাদের স্কুলের ভোট কেন্দ্রে সেদিন পুলিশ আর নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা লোকজন ছাড়া অন্য লোকজন খুব একটা ছিল না। আমরাও সেই সুযোগে স্কুলের ঘরের একেবারে সামনের মাঠে ফুটবলের আনন্দে মেতে উঠেছিলাম।
মাঠটি ভোট কেন্দ্রের এরিয়ার ভিতরেই যেখানে আমাদের প্রবেশ অধিকার নেই। তারপরও পুলিশ বা অন্য কেউই আমাদের বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি কারণ তারা ভোটার শূন্য কেন্দ্রে বেকার সময় পার করছিলো। বরং একসময় আমাদের খেলার দর্শক বনে যান তারাই।
অন্যদিকে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা আমাদের শিক্ষক একসময় আমাদের কেন্দ্রের ভেতরে ডেকে নিয়ে যান ভোট দেওয়ার জন্য। তিনি আমাদের হাতে একটি করে ব্যালট বই তুলে দিয়ে সিল মারতে বললেন। বললেন ১০ টি করে ‘হ্যাঁ’ মারতে আর তার বিপরীতে একটি বা দুটি করে ‘না’ ভোটে সিল মারতে। কারণ বাক্স যদি না ভরে তাদেরতো চাকরি থাকবে না।
আমাদের সেকি আনন্দ! কেউ কেউ ৫০ বা ১০০ ভোটও দিয়েছিলাম সেদিন। জীবনে কোনদিন আর ভোট না দিলেও চলবে।
বড় হয়ে বুঝেছিলাম নিজের শিক্ষকেরই অনুরোধে কি নির্মম অন্যায় আনন্দে মেতে উঠেছিলাম আমরা! বড় হতে হতে বা বড় হয়ে বহু ভোটই দেখেছি, এর বা ওর আমলে। সবই ক্ষমতা লোভীদের মিথ্যা মিথ্যা প্রহসনের খেলা। তবে দুই/ তিনটে নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্য হয়নি তা বলবো না, যেগুলো হয়েছিল নিরপেক্ষ সরকারের তত্ত্বাবধানে। যাই হোক বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনের হালচাল সবারই জানা। জোর যার মুল্লুক তার, এই নীতিতেই চলে ক্ষমতার পালাবদল। যেখানে আমজনতার অবস্থা অনেকটা বলদ সদৃশ্য!
সম্প্রতি আমেরিকায় নির্বাচন হলো। এদের ভোট নিয়ে মারামারি, কাড়াকাড়ি কিছুই দেখলাম না। এরা পোস্টার ব্যানার টাঙিয়ে পরিবেশ ধ্বংস করে না। রাস্তা আটকে মানুষদের অসহায় করেনা। মাইক বাজিয়ে কারো কান ফাটায় না। কেন্দ্র দখলের কনসেপ্ট বা আগের রাতে কিস্তিমাত, এসব কালচার এখানে অচল। ট্রেনে বাসে হাটে মাঠে ঘাটে কোন ঝামেলা কিংবা জটলা চোখে পড়ে না।
নির্বাচনের সময় এখানকার পরিবেশ বাংলাদেশের থেকে এতটাই আলাদা যে নির্বাচন হচ্ছে কি হচ্ছে না এটাই ঠাওর করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। মেগা শপে যান, যেখানে হাজার লোক একসাথে বাজার করে বা মেগা মলগুলোতে যান সেখানেও হাজারো মানুষের ভিড় কিন্তু সেখানে কমলা, বাইডেন, ট্রাম্প, এমন আলোচনা বা তর্ক শোনা যায় না। মানুষ যে যার মত চলছে, যার যার মত কাজ করছে।
আমি নিজে দুই ধরনের দুটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি বিধায় প্রতিদিন আমার অসংখ্য কলিগের সাথে দেখা বা কথা হয়, আড্ডা হয়। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে এরা কেমন নিরব। এখানকার নির্বাচনের এক দেড় মাস আগের কথা বাদই দিলাম নির্বাচনের দিনেও আমাদের রিয়েল স্টেট অফিসে কিংবা আমার স্কুলে নির্বাচন নিয়ে কথা বা আলোচনা শুনিনি বললেই চলে। কে কাকে ভোট দিল বা ভোট দেবে এমন প্রশ্ন করা যেন এখানে অভদ্রতা। হয়তো কেউ কাউকে বড় জোর জিজ্ঞেস করছে, ভোট দিয়েছে কিনা বা কখন ভোট দিতে যাবে, এ পর্যন্তই। তবে ভোট দেয়ার জন্য সবাই সবাইকে উৎসাহ দেয়। নিউইয়র্ক শহরের আমি যে ছোট এলাকায় থাকি সেখানেও নির্বাচনের আগে কামালা ও ট্রাম্প ভিজিট করেছে কিন্তু আমরা অনেকটা টেরই পাইনি। আমার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে এসে একদিন খবর দিল, জানো কামালা আর ট্রাম্প ঐ ঐ দিন আমাদের ঐ ঐ এলাকা ঘুরে গেছে।
তবে হ্যাঁ নিউইয়র্কে বসবাসরত বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় কিন্তু কয়েক মাস আগে থেকেই সরগরম ছিল। চিল্লাচিল্লি, গালাগালি, তর্কযুদ্ধ, চা, পান, বিড়িতে মেতেছিল বীর বাঙালি। বাইডেন কামালা ট্রাম্প হাসিনা খালেদা ইউনুস সহ কত জনের ভবিষ্যৎ যে তাদের হাতে ঝুলছে! কত ধরনের সমীক্ষা আর কত ধরনের চাপাবাজি। কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না এই কথাটির মান যেন আমরা বাঙালিরা ধরে রেখেছি। নতুবা বলুন প্রশান্ত মহাসাগর আর আটলান্টিক মহাসাগরে স্নানের পরেও আমাদের খাসলত ধুয়ে মুছে জায়নি। নিজের চরকার তেল ফুরিয়ে এমন অক্লান্ত জাবর কাটা জাতি আর কোথাও আছে বলে কেউ জানেন কি?
প্রিয় পাঠক, এই প্রশ্ন রেখেই আজকের মত শেষ করছি। আপনাদের উত্তরের প্রতীক্ষায় রইলাম। পরের সংখ্যায় দুই দেশের নির্বাচন পরবর্তী অবস্থা নিয়ে লিখব। আপনাদের সবার মঙ্গল হোক।
লেখক: অভিনেতা।