ছবি - নবযুগ
“দুয়ার খুলে. বাহির হয়ে যা রে” এটি রবীন্দ্রনাথের একটি গানের লাইন। আমিও যেন সবসময় বাহির হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকি! শুধু ডাক দিলেই হলো! কোথাও যাওয়ার কথা বললে আমি না করেছি এই ঘটনা খুব বেশি ঘটেছে বলে মনে করতে পারছি না। আর ভাগ্য দেবতাও কিছুদিন পরপর কোথাও না কোথাও আমাকে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। নতুন জায়গা আর নতুন মানুষ সব সময়ই আমাকে প্রবল ভাবে টানে। এবার ঘুরে এলাম টেনেসির মেমফিস সিটি থেকে।
হঠাৎ করেই টিবিএন ২৪ টেলিভিশনের ম্যানেজার পারভেজ বারভূইয়া ভাই ফোন করে বললেন, টেনেসি থেকে একটু ঘুরে আসেন। শনিবার যাওয়া আর রোববারের অনুষ্ঠান কাভার করে সোমবার ফিরে আসা। তার মানে আমাকে সোমবার সরকারি অফিসে ছুটি নিতে হবে। আমি এখন টিবিএন ২৪ টেলিভিশনে পার্ট টাইম কাজ করি। নিউইয়র্ক সিটির একটি সরকারি অফিসে মূলত কাজ করি। যেহেতু টেনেসি আগে কখনো যাই নাই তাই অফিসে কথা বলে পারভেজ ভাইকে যাওয়ার কথা জানিয়ে দিলাম।
মেমফিসে ‘বাংলাদেশী বিজনেস এসোসিয়েশন অব ট্রাই স্টেইট’-বিবিএটি গত ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ একটি জমকালো পিঠা উৎসবের আয়োজন করেছিলো। আমরা টিবিএন ২৪ টেলিভিশন সেই অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলাম। নিউইয়র্ক থেকে আরো তিন জন্য গুনী শিল্পী আফতাব জনি, নাজু আখন্দ ও কামরুজ্জামান বকুল গিয়েছিলেন গান গাওয়ার জন্য। বকুল ভাই ও নাজু আপাসহ আরো কয়েকজন আমরা একই বিমানে লাগোর্ডিয়া এয়ারপোর্ট থেকে মেমফিসে যাই্।
টেনেসি নানা কারণেই অ্যামেরিকার বিখ্যাত একটি স্টেইট। বিশেষ করে টেনেসির ন্যাশভিলকে অ্যামেরিকার কান্ট্রি সং এর আতুরঘর বলা হয়। অ্যামেরিকার কালজয়ী শিল্পী, কিং অব রক এন্ড রোল খ্যাত এলভিস প্রিসলির বাড়ি-যাদুঘরও মেমফিস সিটিতে। আর ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে হত্যা করা হয়েছিলো এই মেমফিস সিটিতেই। উত্তর অ্যামেরিকার সবচেয়ে বড় মসজিদগুলোর একটি মেমফিস মুসলিম সেন্টার-এমআইসি। আর এখন বাঙালি ব্যবসায়ীদের রত্নভান্ডার বলা যায় এই মেমফিস সিটিকে!
টেনেসির শুধু মেমফিসেই প্রায় ৩০০ গ্যাস স্টেশনের মালিক বাংলাদেশি অ্যামেরিকান ব্যবসায়ীরা। যাদের বেশির ভাগ সেখানে গিয়েছেন নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, মিশিগান ও জর্জিয়া থেকে। মেমফিস সিটিতে গিয়ে আপনি যে বাংলাদেশির সাথেই কথা বলবেন, তারই জানবেন একাধিক গ্যাস স্টেশন আছে। নিউইয়র্কের মতো বাঙালি অধ্যুষিত আর পরিচিত মহল ছেড়ে যারাই মেমফিসে গিয়েছেন তারাই এখন অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী। তাদের গ্যাস স্টেশনের পরিধি যেমন মেমফিসকে ছাড়িয়ে এখন আশেপাশের স্টেইট অ্যালাবামা, মিসিসিপিতেও বিস্তৃত হচ্ছে। অনেকে গ্যাস স্টেশনের বাইরে অন্য অনেক ব্যবসায় বিনিয়োগ করেও সফল হচ্ছেন। মাত্র কয়েক বছরে মেমফিসে বাঙালিদের ব্যবসার এই বিরাট প্রসার ঘটলেও তাদের শুরুগুলো কিন্তু কঠিনই ছিলো। কিন্তু সাহস আর মরণকামড় দিয়ে পড়ে থাকলে যে উন্নতি হবেই বার চাক্ষস প্রমাণ দিলেন মেমফিসের বাংলাদেশিরা।
অ্যামেরিকায় গত ৫০ বছরে বাঙালিরা পড়াশোনা, চাকুরি ও ব্যবসায় দারূনভাবে সফল হচ্ছেন। এর মূল কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে, বাঙালিরা কঠোর পরিশ্রমী জাতি। একটু সুযোগ পেলেই তারা দারুন কিছু করে দেখাতে পারে। বাঙালিরা প্রায় সবাই অ্যামেরিকায় আসার কিছুদিন পরেই গাড়ি কিনেন এরপর বাড়ি কেনার পরিকল্পনা করেন। আর নিজেদের সন্তানদের পড়াশোনায় সর্বোচ্চ সাহায্য করার চেষ্টা করেন।
আবারো মেমফিসের কথায় আসি। সেখানে আমরা গিয়েছিলাম বিবিএটি-এর আমন্ত্রণে। একটি শীতকালীন পিঠা উৎসবকে ঘিরে তাদের প্রস্ততি ও কর্মযজ্ঞ দেখে সত্যি অভিভূত হয়েছি। বিবিএটি এর সভাপতি আব্দুর রহিম গাজী, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রহিম মিয়া এবং পিঠা উৎসবের সভপতি রফিক হাওলাদার ও আহবায়ক মোহাম্মদ এরশাদুল্লাহসহ পুরো আয়োজক টিম যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তার রুপ দেখা গেছে অনুষ্ঠানটির সাজানো গোছানো চিত্র দেখে। বাংলাদেশর প্রায় সব অঞ্চলের বাহারি পিঠা নিয়ে দুপুরের আগেই নারীরা হাজির হন অনুষ্ঠানস্থলে। নারীরা মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজেদের এলাকার ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছেন। আর অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া প্রতিটি মানুষের কাছে প্যাকেটে সাজিয়ে পর্যাপ্ত পিঠা দেয়া হয়েছে। সবার জন্য পান বিতরণটাও ছিলো দেখার মতো। শুরুতে মেমফিসে বাসকরা কয়েকজন শিল্পী সংগীত পরিবেশন করেন। এরপর নিউইয়র্কের শিল্পীরা কয়েকঘন্টার জন্য সবাইকে মাতিয়ে রাখেন। আর বিবিএটি এর সভাপতি আব্দুর রহিম গাজী ভাইয়ের সাবলীল উপস্থাপনা অনুষ্ঠানটিকে সত্যিকার অর্থে প্রাণবন্ত করে রাখে।
আমাদের বাংলা সংস্কৃতির এই আয়োজনগুলোর নানা তাৎপর্য আছে। বিশেষ করে প্রবাসে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্ম আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা সুন্দর ধারণা পায়। আর এ ধরণের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সবার সাথে একটি বন্ধুত্বের সেতুবন্ধনও তৈরি হয়। বিবিএটি মেমফিসে প্রতিবছর কয়েকটি বড় ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।
ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই বলে বাংলায় একটি প্রবাদ আছে। মেমফিসেও আমাদের মানুষ বাড়ছে। আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে ভাগও হচ্ছে। তবে এই ভাগটা যেন প্রতিযোগিতায় থাকে, প্রতিহিংসায় না যায়।
শনিবার বিকালে মেমফিসে যাওয়ার পর রোববার দিনভর আকাশের কান্না। এর মাঝেও বেশ কিছু দেখার সুযোগ পেয়েছি উৎসবের মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর ও অন্যতম আয়োজক আবদুল মতিন ভাইয়ের বদান্যতায়। মতিন ভাই কথা দিয়েছেন আবার গেলে অনেক বিখ্যাত জায়গায় নিয়ে যাবেন! আমি যে কেবল নতুন জায়গা আর নতুন মানুষের কাছেই যেতে চাই। আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ!