
খাইরুল ইসলাম পাখি
“ আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়”-
হরিশচন্দ্র মিত্রের এই বিখ্যাত পঙক্তির কথা আমরা কে না জানি কিন্তু এই সুন্দর সত্যটি জানার পরও আপন ঢোল বাজাতে বাজাতে আমরা কেন যেন হাতে ফোঁসকা ফেলে দিই। নিজের সম্বন্ধে জাবর কাটতে কাটতে মুখ ব্যথা করে ফেলি। দিনে দিনে এই প্রবণতা বাড়ছে তো বাড়ছেই। অধুনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের এই স্থূল কান্ড কীর্তি আরো বেশি মূর্তমান।
আমরা বলি ফলবান বৃক্ষ ফলের ভারে নুজ্য হয়, আমরা বলি ভরা কলসি বাজে কম। তাই যদি হয় তবে তো এটাই সত্য, যে জ্ঞানী তার ভার বা স্থিতি বেশি। জ্ঞানী জনের মাঝে আস্ফালন, হুংকার এসব দুর্বল কর্ম চোখে পড়ে না। তাঁদের যত যশ, খ্যাতি তা অন্যরাই বলে থাকে। তাঁদের কর্মই তাঁদের অমর করে রাখে। আর যারা অন্তঃসারশূন্য তাদের মাঝে জ্ঞান গরিমা কম, তাই তাদের আওয়াজও বেশি। তারাই জাহির করতে পছন্দ করে। তারা নিজেরা জানে নিজের বড়াই করা ছাড়া, তাদের কারো নজরে আসার কারণ নেই। তাই লোক দেখানো সব কর্ম করতেই তারা গলদ ধর্ম হয়। আর ইদানিং তো যতই সস্তা ও ভাঁড়মো জিনিস করা যায় ততই ভাইরাল বা ভিউ পাওয়া যায়।
ধর্মব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিক কিংবা সব শ্রেণি পেশার মানুষের মাঝেই এই অশুভ চর্চা আজ বিদ্যমান, যৎসামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া। আমাদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক আচরণ পরিবর্তন করাটাও জরুরি। ধর্মব্যবসা আর রাজনীতি যাদের পেশা তারা চিৎকার আর গর্জন করে করে সমাজকে বিষিয়ে তুলছে এবং সেসবের ভুল প্রতিক্রিয়াও পড়ছে পরিবার ও ব্যক্তি জীবনে। এই যে আমরা উল্টো পথে হাঁটছি তাতে লাভের লাভ বা কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বরং ম্লান হচ্ছে সুখ ও শান্তি। মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি ও সহমর্মিতা যেন তলানি ছুঁয়েছে। আর একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ মানুষতো ভুলেই যাচ্ছে।
ধরুন, এই যে ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম এর মত মাধ্যম আমরা যেভাবে যাচ্ছে তাই ভাবে ব্যবহার করছি, তাতে তো পারস্পারিক সম্প্রীতি আরো লোপ পাচ্ছে, বাড়ছে ঈর্ষা। এই যে আমরা নিজের প্রাইভেসি ভুলে সর্বস্ব খুলে দেই সর্বসাধারণের জন্য তাতে যে কি ক্ষতি হচ্ছে নিজের বা সমাজের তা কি আমরা ভাবছি? লক্ষ কোটি লোক যখন অভুক্ত, তখন আমরা খাবারের প্রদর্শনী করি সারাক্ষণ। যেখানে অজস্র মানুষের লজ্জা নিবারণের কাপড় নেই, সেখানে আমাদের
কার কত কি আছে সেসব নিয়ে রং আর ঢং এর সীমা আমরা হারিয়ে ফেলি। যেখানে মানুষ মরে যুদ্ধে বিগ্রহে আর আমরা সেখানে উৎসবে, নাচে, গানে, পানে বুদ হই আর তা উগলে দেই সোশ্যাল মিডিয়ামে সঙ্গে সঙ্গে। আমি কি হনুরে করতে করতে মানুষ থেকে আমরা যে হনুমান হয়ে যাচ্ছি তা আমাদের বোধ আসছে না। কি এক অবক্ষয়ের নাচনে নাচছি সবাই। জীবনে আনন্দ উল্লাস থাকবেই, বহিঃপ্রকাশও থাকবে কিন্তু সেসব প্রকাশে আশপাশ ভাবতে হয় বৈকি।
যদি ভাবি আমাদের অতি প্রদর্শনী কতশত অজানা মনে বিরূপ দাগ কাটে বা বেদনা ছড়ায়, যদি ভাবি আমাদের এই দেখানোর প্রতিযোগিতা নিজেদেরই তুচ্ছ বা খেলো করে তোলে, তবেই কিন্তু অযাচিত এসব প্রদর্শনী প্রদর্শনী খেলা বন্ধ হবে বা অন্তত কমবে। যদি আমরা ভাবতে পারি নিজেকে সস্তা বা সহজলভ্য করে শেষটায় লাভ নেই, ওসব লেফাফা দূরস্তদের লম্প ঝম্প, তবেই নিজেদের পরিশোধন সম্ভব। কিংবা সব বিষয়ে সংযত আচরণেই আত্ম পরিমার্জন সম্ভবষ যা সুস্থ সমাজ কিংবা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য সহায়ক। তাই আসুন শুধুমাত্র নিজের ঢোল না পিটিয়ে অন্যের বাজনাও শুনি, অন্যদের কথাও ভাবি আর সকলে মিলেমিশে শুভ দিনের জন্য দিনক্ষণ গুনি।
লেখক অভিনেতা।