ছবি: সংগৃহীত
আমরা ১৪ ভাইবোন। মানিক ভাইয়ের পরের ভাই মুনীর ভাই–৪৭ বছর বয়সে ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার দু’দিন আগে যাকে আমরা হারালাম। আলবদর আর পাকিস্তানি হানাদার আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে নৃশংসভাবে মুনীর ভাইকে হত্যা করে। আমি তখন দিল্লিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ও আমার স্বামী ভারতে চলে গিয়েছিলাম। মুনীর ভাইকে শুধু আমরা নই, তাঁর শ্যালক বাদল ভাই ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি শুনেছি বাদল ভাই বলেছিলেন,‘আমি আপনাকে চ্যাংদোলা করে ঢাকা থেকে নিয়ে যাব।’ তিনি যাননি। এটাকেই বোধহয় নিয়তি বলে।
মুনীর ভাইকে প্রায়ই বলতে শুনতাম, ‘আমার কিছু হবে না। আমি কী করেছি যে ওরা আমাকে মারবে?’ কিন্তু তিনি নিজেও জানতেন না, তাঁর মতো জ্ঞানসমৃদ্ধ বুদ্ধিজীবী দেশের কী ছিলেন,কতখানি ছিলেন, কত বড় সম্পদ ছিলেন। পাকিস্তানিরা ঠিকই বুঝেছিল একটি দেশকে খোঁড়া করতে হলে বুদ্ধিজীবীদের নিধন করতে হবে। তাই তারা পরাজিত হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মুনীর ভাইকে চিনতে তারা ভুল করেনি।
আমার ভাইবোনদের মধ্যে মুনীর ভাই সবচেয়ে মেধাবী ছিলেন বলে মনে হয়। সবচেয়ে রসিক ছিলেন। ওই একটা মাথার মধ্যে কত যে বুদ্ধি,কত যে লেখাপড়া ছিল, তা আর বলার নয়। মুনীর ভাই দুটি বিষয়ে এমএপাস করেছেন। প্রথমবার ইংরেজিতে। তারপর বাংলায়। বাংলায় এমএ করেছেন জেলখানায় বসে। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। মুনীর ভাই বড্ড সুন্দর করে কথা বলতেন, শব্দ ব্যবহার ও শব্দ চয়ন বড্ড ভালো ছিল তাঁর। একটু বইয়ের ভাষা বলতে ভালোবাসতেন– কিছু মাইকেল থেকে নিতেন, কখনও রবীন্দ্রনাথ, কখনও বাবঙ্কিম। আমার মায়ের হাতের আটার রুটি আর আলু ভাজি বড় সুস্বাদু ছিল। মুনীর ভাই ভারি পছন্দ করতেন।
তাঁর ভাষাটা সত্যি এক আলোচ্য বিষয় ছিল। সুন্দর সুন্দর কঠিন বাংলা শব্দ ব্যবহার তাঁর স্বভাবজাত ছিল। তিনি যখন অবলীলায় ওই ভাষার কথা বলতেন, আমরা তা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম; তাঁর মুখে একটুও অস্বাভাবিক মনে হতো না। অনেক সময় নিজেরা ওই ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করতাম,কিন্তু বৃথা চেষ্টা– নিজের কানেই নিজেকে হাস্যকর ঠেকত। তাঁর অনুবাদ পড়ে মনে হয় না যে তা অনুবাদ। এত সহজ এত গতিশীল। তার গুণের শেষ ছিল না। এত অল্পকথায় তা বলা কঠিন। প্রিয় ভাইকে খুব মনে পড়ে। সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর জন্য প্রার্থনা রইল।