ফাইল ছবি
- আমেরিকা ইজ অ্যা গ্রেট কান্ট্রি।
- মুক্তি, কথাটা তুমি আগেও একদিন বলেছিলে, খুব ফার্ম ছিল কন্ঠ সেদিন।
- আর আজ?
- আজও তেমনি আছে। সেই দিনটির কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে।
- বিশেষ কোনো দিন ছিল?
- না, দিবসের কোনো বিশেষত্ব ছিল না। একটি সাধারণ দিন খুব অসাধারণ হয়ে উঠেছিল। আমরা লঙ আইল্যান্ড থেকে ফিরছিলাম। পাতা ঝরার কাল। দুপাশের বৃক্ষসারি লাল-হলুদ রঙে সেজেছে। হঠাৎ রাস্তাটি পাহাড়ে উঠছিল আর খুব প্রশস্ত হয়ে উঠছিল। দুপাশের লোকালয় বহুদূর অব্দি দেখা যাচ্ছিল। সারি সারি বাড়িঘর। বিচিত্র রঙের টালি, এসফল্ট শিঙ্গেলসের ঢেউ হেমন্তের সমান্তরাল এসে দাঁড়িয়েছে। আমার হাতে টয়োটা সিয়েনার স্টিয়ারিং। হঠাৎ তুমি বলে উঠলে আমেরিকা ইজ অ্যা গ্রেট কান্ট্রি। যেন আমার হৃদয়ে সেই মুহূর্তে যে অনুভূতিটা দানা বেঁধে উঠছিল তা তোমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।
- ঠিক এমন ঘটনা আমার বেলায় বেশি ঘটে জহির। আমি যা ভাবি পাশ থেকে তুমি তা বলে ওঠো।
- এজন্যই বোধ হয় দুই যুগ আগে অরহুসে বসে ভারতীয় নারী বিদ্যা বলেছিল, মেইড ফর ইচ আদার।
- আরো অনেকেই বলেছে।
- হুম। আমি নিজেও তা বিশ্বাস করি।
- আমি করি না বলছো?
- তুমিও করো। আচ্ছা এখন বলো কি কারণে আমেরিকা ইজ গ্রেট? গ্রেট শব্দটি শুনলেই তো ট্রাম্পের গ্রেট বানানোর প্রহসনের কথা মনে পড়ে যায়।
- এই যে তুমি ট্রাম্পের মন্দ-চিন্তার কথা অকপটে বলতে পারলে, তার শাসনামলে সবাই প্রকাশ্যে তার নিন্দা করেছে, এই বাক-স্বাধীনতার জন্যই আমেরিকা গ্রেট।
- এটা আমেরিকানদের প্রতি মুহূর্তে শেখানো হয়। আমি যখন আইভরিকোস্টে কাজ করি, একজন ব্লাক আমেরিকান মহিলা, খুব উল্টাপাল্টা কথা বলছিল আমার রুমে বসে। তার কথাগুলো প্রায় শিষ্টাচারের বাইরে ছিল। বিশেষ করে তার উচ্চকণ্ঠ এবং বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। আমি তাকে খুব ভদ্রভাবেই বলি, তুমি এভাবে কথা বলতে পারো না। সে আমাকে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, আমি একজন আমেরিকান, বাক-স্বাধীনতা আমার অধিকার। আমার যা খুশি আমি তাই বলবো।
- হ্যাঁ, যা খুশি তা বলার অধিকার ওদের আছে এবং এই চর্চা শিশুকাল থেকেই ওরা করে কিন্তু বড় হতে হতে শিষ্টাচারটাও শিখে ফেলে এবং তখন কেবল জোরে-সোরে, নির্ভয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। বাক-স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে কেউ অহেতুক অন্যকে আক্রমণ করে না।
- ওরা যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করে তখন একথা চিন্তা করে না কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে।
- একদম। সেটা নিজের বাবা, মা, ভাই-বোন, নিজের দলের নেতা, দেশের প্রেসিডেন্ট কিংবা পুলিশের হোমরা-চোমরা যে কেউ হতে পারে।
- দেখো কিছুদিন আগে ট্রাম্পের সমর্থকরা ক্যাপিটোলে যা করলো তার জন্য তারই ভাইস প্রেসিডেন্ট, সেনা সদর, কেবিনেট কেউ তাকে সমর্থন করেনি। সবাই বলেছে এটা অন্যায়।
- অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারার স্বাধীনতা উন্নত দেশগুলোতে আছে।
- অ্যান্ড আমেরিকা ইজ দ্য বেস্ট।
- দ্বিমত করছি না।
- আরেকটা জিনিস আমি লক্ষ করেছি, নিজের বিরুদ্ধে গেলেও, শেষ পর্যন্ত কিন্তু ওরা সত্যের ওপরই দাঁড়ায়। ক্লিনটন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার যৌন-কেলেংকারীর দায় নিয়েছে, স্বীকার করেছে।
- সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে অনেক তুচ্ছ অপরাধের দায় নিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার ঘটনাও উন্নত দেশে ঘটে।
- আমি জানি তুমি ইংল্যান্ডের মন্ত্রী ক্রিস হুনের কথা বলবে।
- এগজাক্টলি, কি করে বুঝলে?
- এই ঘটনা তুমি আমাকে আগেও বহুবার বলেছ। তখন তুমি ইংল্যান্ডের রাজনীতি নিয়ে খুব স্টাডি করতে।
- আসলে ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডে মাইগ্রেট করার পর ভেবেছি এই দেশে যখন থাকবোই দেশটাকে ভালো করে জানি। ওদের সততা, মানবিক বোধ আমাকে খুবই আপ্লুত করেছে। যত জেনেছি ততোই বিস্মিত হয়েছি।
- দেখো মানুষের এই আচরণটাই স্বাভাবিক হবার কথা। কিন্তু উল্টোটা এতো বেশি দেখি যে মন্দটাই এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে, ভালোটা দেখলেই বরং এখন আমরা অবাক হই।
- ২০১২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ক্রিস হুনে পদত্যাগ করেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কারণটি খুব হাস্যকর, তাই খুব অবাক হয়েছিলাম।
- ট্রাফিক আইন অমান্য করেছিল?
- মূল অপরাধটা ছিল মিথ্যা বলা। ২০০৩ সালে ওভার স্পিডিং করে টিকেট খেয়েছিল ক্রিস। সম্ভবত সেবার পয়েন্ট কাটা গেলেই তার ড্রাইভিং লাইসেন্স সাসপেন্ড হয়ে যেত। তাই লাইসেন্স ঠিক রাখার জন্য মিথ্যা বলেছিল। কোর্টে গিয়ে ক্রিস বলেছিল সে নয় তার স্ত্রী গাড়ি চালাচ্ছিল। নয় বছর পর তার স্ত্রী ভিকি প্রাইস এই সত্য প্রকাশ করে দেয়। মিথ্যা বলার অপবাদ মাথায় নিয়ে তিনি মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। নিজেকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করেননি। শুধু তাই নয়, তার এবং তার স্ত্রীর আট মাসের কারাদন্ডও হয়।
- আমার মনে আছে উপুর্যপরি লঞ্চডুবির কারণে একজন সাংবাদিক বাংলাদেশের তৎকালীন নৌ পরিবহন মন্ত্রী আকবর হোসেনকে প্রশ্ন করেছিলেন ব্যর্থতার দায়ে পদত্যাগ করবেন কিনা। তিনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন, আমি পদত্যাগ করলে এই সমস্যার সমাধান করবে কে?
- কত বড় বড় ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় আমাদের মন্ত্রীরা। শুধু কি তাই নির্লজ্জের মতো মিথ্যা বলে, অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়। খারাপ ঘটনা ঘটলে কথায় কথায় বলে আমেরিকাতেও তো ঘটে। কিন্তু আমেরিকার হাজারটা ভালো ঘটনা আছে সেইগুলির কথা তারা কখনোই বলে না।
- শোনো আমাদের মন্ত্রীরা হলো দুধ খাওয়া মজনু, তারা রক্ত দেওয়া মজনু না।
- গল্পটা জানি, একবার বলেছিলে, ভুলে গেছি।
- শুনতে চাও?
- হ্যাঁ, বলো না প্লিজ।
- লাইলি-মজনুর অমর প্রেম কাহিনীর গল্প এটা। লাইলির বাবা লাইলিকে গৃহবন্দি করে ফেলে যাতে সে কিছুতেই মজনুর সাথে দেখা করতে না পারে। মজনু তো পাগল হয়ে বনে-বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লাইলিও খুব কষ্টে আছে। না জানি মজনু তার দেখা না পেয়ে উন্মাদ হয়ে গেছে, না খেয়ে খেয়ে মরে যাচ্ছে। একদিন লাইলির বাঁদি এসে খবর দেয়, আমি ওই পাহাড়ে ছেঁড়া জামা-জুতো পরা এক পাগলকে দেখে এসেছি, সারাক্ষণ লাইলি লাইলি করছে। লাইলি তখন এক হাঁড়ি দুধ জাল দিয়ে ঘন করে একটি পাত্রে ঢেলে তার বাঁদিকে দিয়ে বলে, যা আমার মজনুকে দিয়ে আয়। বাঁদি খালি পাত্র নিয়ে ফিরে এলে লাইলি জিজ্ঞেস করে, মজনু দুধ পেয়ে কি করলো? বাঁদি বলে, দুধটা খেয়ে পাত্রটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। লাইলি ভাবে সে আমার মজনু হতে পারে না। আমার মজনু দুধের পাত্রে চুমু খাবে, সারা গায়ে পাত্রটা পাগলের মতো ছোঁয়াবে। পরদিন লাইলি বাঁদিকে দুধের সাথে একটি ছুরি দিয়ে বলে, দুধ খাওয়া হয়ে গেলে মজনুকে বলবি, এই ছুরি দিয়ে নিজের দেহ কেটে আমার জন্য কিছু রক্ত দিতে, আমি মজনুর রক্ত খেতে চাই। একথা শুনে মজনু দুধের পাত্র আর ছুরি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে, আমি দুধ খাওয়া মজনু, রক্ত দেওয়া মজনু না।
- হা হা হা। আমাদের পলিটিশিয়ানরা যথার্থই দুধ খাওয়া মজনু।