যে গ্রামের মানুষ জুতা পরে না
ভাবতে অবাক লাগলে এই আধুনিক যুগেও ভারতের একটি গ্রামের নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল বাসিন্দা সারা বছর খালি পায়ে থাকে, তারা কোন ধরনের জুতা পরে না। এমনকি তাদের বাইরে কোথাও যাওয়ার দরকার হলেও খালি পায়েই যাতায়াত করে।
শুধু এটাই নয়, পরিবারের কেউ যদি অসুস্থ হয়, তাহলেও তারা হাসপাতালে যায় না। আর কোন কারণে যদি তাদের আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার দরকার হয় বা অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার হয় তাহলে তারা বাইরের কোন খাবার এমনকি পানিও পান করে না।
গ্রামটি ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের তিরুপাতি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে। নাম ভেমানা ইন্দলু।
এই গ্রামের বাসিন্দারা জানায় যে, এটা তাদের অনেক পুরনো ঐতিহ্য। গ্রামবাসীরা বলছেন যে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যখন এই গ্রামে প্রবেশ করেন তখন তিনি নিজেও জুতা খুলেই প্রবেশ করেন।
গ্রাম প্রধান ইরাব্বা বলেন, এই গ্রামে আমাদের সম্প্রদায় এসে বসবাস শুরু করার সময় থেকেই এই রীতি চলে আসছে।
তিনি বিবিসি তেলেগুকে বলেন, “আমরা যখন বাইরে যাই, ফিরে এসে আমরা আগে গোসল করি, তারপর বাড়িতে ঢুকি ও খাবার খাই। আমি অনেকবার আমার গ্রামের বাইরে গিয়েছি। একবার আদালতের একটি কাজে আমাকে পাঁচ দিন গ্রাম থেকে বাইরে থাকতে হয়েছিল। যেখানে আমি ছিলাম, সেখানকার কোন খাবার আমি স্পর্শ পর্যন্ত করিনি।”
ইরাব্বা বলেন, “৪৭ বছর ধরে আমাকে আদালতের কাজের জন্য বাইরে যেতে হয়। কিন্তু আমি কখনোই বাইরে গিয়ে পানি ছাড়া আর কিছুই পান করি না। পান করার জন্য পানি আমি বাড়ি থেকে নিয়ে যাই এবং সেই পানিই পান করি। বাইরে থেকে পানি পান করার প্রশ্নই উঠে না। এমনকি আমরা বাইরে খাবারও খাই না।”
এই গ্রামে ২৫টি ঘর আছে যার বাসিন্দা মোট ৮০ জন মানুষ। এর মধ্যে মোট ৫২ জন ভোটার রয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র হাতে গোনা কয়েক জন স্নাতক শেষ করেছেন। এখানকার মানুষ খুব একটা শিক্ষিত নয় এবং তারা কৃষির উপরই নির্ভর করে।
আরো একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদের আত্মীয়-স্বজন যারা এই গ্রামে দেখা করতে আসেন তাদেরকেও এই রীতি মেনে চলতে হয়। অর্থাৎ খালি রাতেই গ্রামে ঢুকতে হয়।
মহেশ নামে এক ব্যক্তি যিনি এই গ্রামে বেড়াতে এসেছেন, তিনি জানান যে, তার বোনের বিয়ে হয়েছে এই গ্রামে। গ্রামে প্রবেশের আগেই আমি জুতা খুলে ফেলি। কোন বাড়িতে যদি আমাদের ঢুকতে হয় তাহলে তার আগে গোসল করতে হয়।
এই গ্রামের শিক্ষিত মানুষেরাও এই রীতি মেনে চলে। এই গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে যে তারা ‘পালভেকারি’ গোত্রের। পালভেকারি মূলত তামিল নাড়–র কৃষক সম্প্রদায় বা গোত্র।
অন্ধু প্রদেশে তাদেরকে নি¤œগোত্রভূক্ত মনে করা হয়। এই গ্রামের সব বাসিন্দা একই গোত্রের। তারা গ্রামের বাইরে কোন আত্মীয়তা করলেও একই গোত্রের মানুষদের সাথেই করে থাকে।
গ্রামের মানুষ প্রাচীন মন্দিরে গিয়ে পূজা-অর্চনা এবং অন্যান্য রীতি-নীতি পালন করে থাকে। গ্রামে তারা নর সিংহ স্বামী ও গঙ্গা মায়ের পূজা করে। তারা বিশ্বাস করে যে, দেবতাই সব কিছুর খেয়াল রাখবেন। যার কারণে এই গ্রামের মানুষ কখনো হাসপাতালে যায় না।
গ্রামের প্রধান ইরাব্বা বলেন, “আমাদের যদি সাপে কামড়ও দেয়, আমরা বিশ্বাস করি যে আমাদের দেবতা সেটি আরোগ্য করবেন। আমরা কোন হাসপাতালে যাই না। আমরা সাপের পাহাড় প্রদক্ষিণ করি। আমরা নিম গাছ প্রদক্ষিণ করি। আমরা হাসপাতালে যাই না।”
‘আমাদের দেবতাই আমাদের খেয়াল রাখেন। আমরা অসুস্থ হলে মন্দির প্রদক্ষিণ করি। এটা করলে দুই দিনের মধ্যে আমাদের রোগ সেরে গিয়ে আমরা আবার সুস্বাস্থ্যবান হয়ে উঠি। এটাই আমাদের ঐতিহ্য।”
এই গ্রামের যে শিশুরা স্কুলে যায় তারাও জুতা পরে না এবং স্কুল থেকে যে দুপুরের খাবার দেয়া হয়, সেটাও তারা খায় না। তারা যদি বাইরের কাউকে স্পর্শ করে তাহলে গোসল না করে বাড়িতে প্রবেশ করে না।
পাশের গ্রামের এক বাসিন্দা ববিতা বলেন, ওই গ্রামের নারীদের মধ্যে কেউ গর্ভবতী হলেও তারা হাসপাতালে যায় না। সবকিছু বাড়িতেই হয়।
ববিতা বলেন, “স্কুলগামী শিশুরাও সেখানে দেয়া দুপুরের খাবার খায় না। তারা খাবার খেতে বাড়িতে ফেরে, খাবার খেয়ে আবার স্কুলে যায়।”
নারীদের ঋতু¯্রাবের সময়ে গ্রামের বাইরে থাকতে হয়। গ্রামের মানুষ মিডিয়া থেকেও নিজেদেরকে দূরে রাখে।
বাবু রেড্ডি যিনি গ্রামের রেশনের দোকান চালান তিনি বলেন, এই গ্রামে যে আসবে যে যদি সরকারি কর্মকর্তা এমনকি পার্লামেন্ট সদস্যও হয়ে থাকেন, তাহলেও তাকে গ্রামের বাইরে জুতা খুলে তারপর প্রবেশ করতে হবে।
“নি¤œ বর্ণের মানুষদের এই গ্রামে প্রবেশের অনুমতি নেই। গ্রামের মানুষ এসব বর্ণের মানুষদের সাথে কথা বলে না, স্পর্শও করে না। প্রতি মাসে ঋতু¯্রাবের সময় নারীদের অন্তত পাঁচ দিন গ্রামের বাইরে থাকতে হয়,” তিনি বলেন।
“গ্রামের বাইরে ঋতু¯্রাবের সময় নারীদের থাকার জন্য কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। রাত-দিন তাদেরকে ওই একই কক্ষে থাকতে হয়। গ্রামের মানুষ সব ধরণের সরকারি সুযোগ-সুবিধা পায়। আমরা তাদের বাড়িতে গিয়ে রেশন দিয়ে আসি, তাদের রেশন অন্যদের থেকে আলাদা এবং শুধু তাদের কাছেই হস্তান্তর করা হয়।”
বিবিসি তিরুপাতি জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ভেঙ্কাটারামি রেড্ডির সাথে কথা বলেছে ভেমানা ইন্দলু গ্রামের এসব রীতি-নীতি নিয়ে।
তিনি বলেন যে, তিনি গ্রামে একটি সচেতনতামূলক প্রচারণার আয়োজন করবেন এবং বাসিন্দাদের মধ্যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করবেন।