ফাইল ছবি
প্রবাসের সবচেয়ে অন্যতম বড় সামাজিক সংগঠন সিলেট জালালাবাদ এসোশিয়েশন। আমি সেই সংগঠনেরই একটি এলাকার লোক হলেও সদস্য হওয়া কিংবা সংগঠনে যুক্ত হওয়ার উৎসাহ, আগ্রহ কিংবা প্রয়োজনবোধ করিনি। কেন করিনি সে বিতর্কে নাইবা গেলাম। যতদূর জানি ৩৮ বছর আগে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা। সংগঠনের সাধারণ সদস্য ১১ হাজার, ৪’শত লাইফ মেম্বার। সংগঠনের সাংগঠনিক পরিকাঠামোর মাথায় যারা বসেছেন, বেশিরভাগই দেখা গেছে গ্রাম্য টাউট-বাটপারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। প্রথমদিকে উৎসাহ উদ্দীপনা থেকে কিছু শিক্ষিত সমাজহিতৈষী ভাল মানুষ দায়িত্বে দেখা গেলেও বাটপার অর্বাচীনদের দৌরাত্বে আত্মসম্মানবোধ থেকে তারা সরে পড়েছেন। ফলে পরিচয় সংকটে ভোগা অশিক্ষিত, অভদ্র কোন্দলবাজদের খপ্পরে পড়ে যায় সম্ভাবনাময় বিরাট সংগঠনটি। দায়িত্বশীল ও দায়িত্ববোধের কেউ আর এগিয়ে আসতে উৎসাহবোধ করেননি।
এই দীর্ঘসময়ে টাউট কোন্দলবাজ এবং কিছু তথাকথিত সুবিধাভোগী পরিচয় সংকটে থাকা নেতৃত্বলোভীদের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে। তাদের ইচ্ছে ও প্রয়োজনমতো দলভারীর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এক গ্রুপ ক্ষমতায় গেছে, আরেক গ্রুপ বাইরে থেকে দখলের প্রয়াসে লিপ্ত থেকেছে। গণ্যমান্য সচেতনদের গা-ছাড়ায় সংগঠনটি এখন এমন অবস্থায় পৌছেছে, মানী, সম্মানী এলাকাবাসীর ইজ্জত নিয়ে টান পড়েছে। তারই ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে গত ১০ জুন, রোববার একটি সভাকে কেন্দ্র করে।
ঘটনার সূত্রপাত সংগঠনের একটি ভবন ক্রয় করাকে কেন্দ্র করে। বিগত আটত্রিশ বছরে পদ ও অর্থলোভী অর্বাচীন কর্মকর্তারা ১১ হাজার সদস্য ও ৪’শত লাইফ মেম্বারদের টাকা আত্মসাৎ এবং নয়ছয় করা ছাড়া গঠনমূলক কিছুই করেননি। এক পর্যায় অর্থ আত্মসাতের পথ হিসেবে ফিলাডেলফিয়ায় সংগঠনের একটি বাড়ি কেনা হয়। প্রতিবাদ উঠে ৯০/৯৫ শতাংশ সদস্যের বসবাস নিউইয়র্কে রেখে ফিলাডেলফিয়ায় বাড়ি কেনা নিয়ে। অবশেষে প্রতিবাদ ও চাপে পড়ে এক পর্যায় বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হয়। তবে এই ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্য দিয়ে ক্রয়কারীদের অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্য যথারীতি পূরণ হয়ে গেছে বলে অনেকেই মনে করেন। দ্বিতীয় ব্যাপার আরও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের ন্যায় পদ ও অর্থ আত্মসাতের পথ আকড়ে রাখতে নিউজার্সি সিটিতে কয়েক বিঘা জমির একটি কবরস্থান কেনা হয়েছে। তৃতীয়তঃ, বছর কয়েক আগে সিলেটের বিশিষ্টজন ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে অঢেল অর্থ অনুদান হিসেবে নিয়ে সিলেট সম্মেলন নামে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। শুনেছি বিতর্কিত সেই সম্মেলনে লাখ দেড়েক ডলার ব্যয় করা হয়েছে, যার প্রাপ্তি শূণ্য হলেও অনেকের পকেট ভারী হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই হলো সিলেট জালালাবাদ সমিতি নামে সর্ববৃহৎ সামাজিক সংগঠনের ৩৮ বছরে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির যোগ বিয়োগ। এবার আসা যাক ১০ জুন কথিত সাধারণ সভাকে কেন্দ্র করে কি ঘটেছিল এবং কেন ঘটেছিল। তার উৎসইবা কি। যতদূর জেনেছি সংগঠনের নামে নতুন একটি ভবন কেনাকে কেন্দ্র করে দু’টি বিবাদমান গ্রুপের সৃষ্টি হয়। সেই দুই গ্রপের বাদবিবাদের ধারাবাহিক ঘটনার ফলশ্রুতি বা পরিণতি ছিল সেদিনের অপমানকর কলঙ্কিত ঘটনা। যে ঘটনা দেশ বিদেশে সমগ্র সিলেটবাসীর গায়ে কালিমা লেপ্টে দিয়ে আত্মসম্মানের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
উল্লেখ্য, ভবন ক্রয়কে কেন্দ্র করে দু’টি বিবাদমান গ্রুপের একদিকে সভাপতিসহ একটি গ্রুপ, অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদকসহ অপর গ্রুপ। সভাপতির ইগো সমস্যা বহুলাংশে ঘটনার জন্য দায়ী বলে ধারণা করা যায়। সভাপতি মিমাংশার পথে না গিয়ে পদ ও অবস্থান ধরে রাখতে ক্ষমতার প্রয়োগ যথার্থ মনে করেছেন। এজন্য পদলোভী সুবিধাবাদী টাউটদের নিয়ে দলভারীর মাধ্যমে কোন্দল ও তিক্ততা বাড়িয়ে তুলেছেন। সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে কিংবা সাধারণ সম্পাদক অন্যায় করে থাকলে জালালাবাদবাসীর সম্মানিত জ্ঞানী গুণী বিজ্ঞজনকে ডেকে দু’পক্ষকে নিয়ে বসে সমাধানের পথ খোঁজা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি, বরং ব্যক্তি দাম্ভিকতা ও ইগো থেকে বহিস্কার ও অবদমনের মাধ্যমে তিক্ততা বাড়িয়ে ১০ জুনের ঘটনার জন্ম দিয়েছেন।
ভবনটি আমার বাসার কাছেই। মাস দুই/তিন আগে একদিন বিকেলে বেড়াতে বেরুলো এক বন্ধু রাস্তা থেকে ধরে ভবন দেখাতে নিয়ে যান। সেদিনই বিষয়টি জানতে পারি। জালালাবাদবাসী বা জালালাবাদ এসোশিয়েসনের জন্য এটি কোনও ভাবে যথার্থ অফিস বা ভবন নয়। তবু শহরের কেন্দ্রস্থলে নাই থাকার চেয়ে আপাতত বসার একটি ঠিকানা হলো। অদূর ভবিষ্যতে কর্মকর্তারা উদ্যোগী হলে বড় কোনও জায়গায় করতে গেলে এটি বিক্রি করলেও ভালো রিটার্ণ পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া টাকা নয়ছয় না হয়ে টাকাগুলোও আপাতত নিশ্চিত থাকলো। বিষয়টি নিয়ে পরদিনই সভাপতি বদরুল খানকে ফোন করি। বলেছিলাম, সবাইকে নিয়ে বসুন, বসে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শেষ করার চেষ্টা করুন। মিমাংশ করতে না পারলে বৃহত্তর সিলেটের বিশিষ্টজনদের ডাকুন, তাদের নিয়ে বসুন। কিন্তু তার উত্তর ছিল তারা (সম্পাদক) সংগঠনের টাকা ফেরত দিক তারপর বাকীটুকু বিবেচনা করে দেখব। সম্পাদকের কথা হলো ভবনটি জালালাবাদ সংগঠনের নামে কেনা। কেনার ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োজনে আমার ত্রুটি হয়ে থাকলে কিংবা হিসেবে গড়মিল থাকলে বসে সবাই মিলে দেখে যে সিদ্ধান্ত নেবেন আমার কোনও আপত্তি নেই। সবার সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিতে রাজি আছি। কিন্তু সভাপতি টাকা ফেরত ছাড়া কোনোও অবস্থায় সম্পাদকের সাথে বসতে রাজি না হওয়ার পরিণতিই ছিল ১০ জুনের ঘটনা। অথচ মজার ব্যাপার ভবন কেনার এগ্রিমেন্টে সভাপতির নিজেরও স্বাক্ষর রয়েছে। এমনকি ভবন উদ্ভোধনের সময় অন্যান্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
এভাবে সভাপতি একগুয়েমী মনোভাব থেকে ১০ জুন একটি সাধারণ সভা আহ্বান করেন স্থানীয় কুইন্স প্যালেসে। সেখানে সম্পাদকসহ অন্য গ্রুপকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বরং তারা যাতে সভার হলে প্রবেশ করতে না পারেন সেজন্য বিরাট বিরাট সুঠামদেহী ১০/১২জন কৃষ্ণাঙ্গ সিকিউরিটি হলের ভেতরে এবং গেইটে মোতায়েন করা হয়।
কৌতুহল নিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। হলের গেইটের অবস্থা দেখে ভেতরে প্রবেশের আর আগ্রহ থাকেনি। ভেতরে সভাপতি তার অনুগতদের নিয়ে অবস্থান করছেন। সিকিউরিটির কাছে সভাপতির দেওয়া তালিকা দেখে দেখে কিছু লোককে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। প্রায় শ’খানেক লোক ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে চেঁচামেচি করছিলেন। একপর্যায় অবস্থা দেখতে সভাপতি গেইটে এলে চোর চোর শ্লোগানে তাড়া খেয়ে ভেতরে চলে যান। বাইরে থেকে হলের অবস্থা ও স্টেজে উপস্থিতদের দিব্বি দেখা যাচ্ছিল। এছাড়া ভেতর থেকে ইউএসএ নিউজ ডক কম লাইভ প্রচার করায় বাইরে থেকেই বক্তব্য শোনা যাচ্ছিল। ভেতরে চেয়ার নিয়ে মারামারি উত্তপ্ত বাকবিত-া সবই দেখা যাচ্ছিল।
লক্ষ্য করলাম এক পর্যায় প্রাক্তন সভাপতি সৈয়দ শওকত আলীকে অনেক চাপাচাপির পর ঢুকতে দেওয়া হয়। তবে সিকিউরিটি তাকে এমনভাবে চেকআপ করেছে, দস্তুরমতো অপমানকর। সৈয়দ শওকত আলীকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি ও জানি। মৌলবীবাজার শহরের সম্মানিত পরিবারের সম্মানিত ব্যক্তি। তার ফুফাতো ভাই মরহুম গজনফর আলী চৌধুরী এই কমিউনিটির একজন পরিচিত সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। জালালাবাদ এসেশিয়েসনেরও একজন সম্মানিত কর্মকর্তা ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে লক্ষ্য করলাম সিকিউরিটি তার শার্টের কলার ধরে টেনে হিছড়ে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছে। অবশ্য গলাধাক্কা দিয়ে বের করার এমন আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে। হলের ভেতরে চেয়ার নিয়ে টানাটানি, মারামারি একটানা সচল ছিল। এমনকি অনেক বক্তা তার বক্তব্যে সভাপতির নাম ধরে চোর সম্বোধন করতেও শোনা যায়, দেখা যায়। সাংবাদিকরা পুরো ঘটনা রেকর্ড করছিলেন। সভাপতি সাঙ্গপাঙ্গ অনুগতদের নিয়ে দিব্বি সভামঞ্চে সবই হজম করছিলেন।
লক্ষণীয় সভাপতির পাশে মঞ্চে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে প্রাক্তন সভাপতি জনৈক মহিলা এবং বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জনৈকা মহিলাসহ প্রাক্তন ও বর্তমানদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। সবাই নির্লিপ্ত থেকে সভাপতির অনুকম্পায় বিগলিত ছিলেন বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। ভেতরের ও বাইরের গালাগাল, চেয়ার ছুড়াছুড়ি, অশ্রাব্য বক্তব্য ইত্যাদি কিছুই তাদের বিবেক ও আত্মসম্মানকে তাড়িত করেছে বলে মনে হয়নি। টিভি ও সাংবাদিকরা রেকর্ড করছিলেন। এই হলো ১০ জুন জালালাবাদ এসোশিয়েসনের সভাপতির সাধারণ সভায় দাম্ভিক আচরণ।
প্রশ্ন হলো সভাপতির এত ঔদ্ধত্যের উৎস বা খুঁটির জোর কোথায়। কে এই সভাপতি। খুঁটির জোর কিছু সুবিধাবাদী তথাকথিত শিক্ষিত, গুরুত্বহীন সংগঠনের প্রাক্তন পদাধিকারী ও পরিচয় সংকটে ভোগা সামাজিকভাবে নি¤œমানের অর্বাচনী ও টাউট। সভাপতির পরিচয় যতদূর জেনেছি, একজন অশিক্ষিত গ্রাম্য মোড়লের চারিত্রিক বৈশিষ্টের অধিকারী। যা, তার আচরণে প্রতীয়মান হয়েছে। সভাপতির পাশে তথাকথিত শিক্ষিত যাদের দেখেছি, করুণা ও লজ্জিত হতে হয় একটি অশিক্ষিতের পাশে তাদের নির্লিপ্ত আনুগত্য প্রকাশ করা দেখে। আরও আশ্চর্য হতে হয় এমন একটি অশিক্ষিত লোক কোন যোগ্যতায় তিন তিন বার সভাপতির পদ আকড়ে থাকতে পারে?
পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই, সভাপতি তিনি যেই হোন না কেন, জালালাবাদবাসীর জন্য কিছু করতে পারেননি তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু জালালাবাদবাসীর আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদায় কলঙ্ক লেপ্টে দেবার অধিকার নিশ্চয় জালালাবাদবাসী তাকে দেয়নি। ১০ জুনের অগে কি ঘটেছে না ঘটেছে সে বিতর্কে না গিয়ে ১০ জুন জালালাবাদবাসীর আত্মমর্যাদা যেভাবে ক্ষুন্ন করেছেন, সেজন্য কেবল সাংগঠনিকভাবেই নয় অন্যভাবে হলেও শাস্তি হওয়া উচিত। সভাপতি হিসেবে এ দায় একমাত্র তার ওপরই বর্তায়। এ অন্যায় অপমানের দায় তাকে নিতেই হবে। আমি মনে করি বিষয়টি নিস্পত্তি করতে হলে জালালাবাদবাসীর বিজ্ঞজনদের এগিয়ে আসতে হবে। দুই গ্রুপকে কানে ধরে একত্রে বসিয়ে সুরাহা করতে হবে। এর বাইরে কোনও বিকল্প আমি দেখছি না। এরপরও যদি জালালাবাদবাসী নীরব নিশ্চুপ থেকে গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে দেন, মনে করবো জালালাবাদবাসীর বিবেক ও আত্মমর্যাদায় স্খলন ঘটেছে, পচন ধরেছে।
লেখক: কলামিস্ট, মুক্তিযোদ্ধা, সভাপতি, যুক্তরাষ্ট্র উদীচী।