ফাইল ছবি
কল্পনা দত্ত যোষীর শরীরের রং ও চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকে লিখেছেন, ওনাকে দেখলে অবাঙালি বলেই মনে হতো। সাধারণ বাঙালী মহিলাদের থেকে অনেকটা বেশি লম্বা, ছিপছিপে সুন্দর গড়ন, বলিষ্ঠ ঋজুদেহ, গায়ের রং কাঁচা হলুদের মতো। হাসি ছিল ভীষণ মিষ্টি। প্রথম দর্শনেই মন জয় করে নেওয়ার মতো তাঁর চেহারায় লাবণ্য। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের নেতা বীর শহীদ সূর্য সেন, পূর্নেন্দু দস্তিদারের নামের সঙ্গে যে দু’জন নারীর নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে আছে তাঁরা হলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত।
২৭শে জুলাই কল্পনা দত্তের জন্ম দিবস। ২০১৩ সালে জন্মশতবর্ষ ছিল। কল্পনা দত্ত এবং প্রীতিলতা এই দুই মহিয়সী মহিলা বাংলাদেশের চট্টগ্রামেই তাদের জন্ম। দেশ ও জাতির মুক্তির জন্য কি দোর্দন্ড সাহসী ত্যাগী ভূমিকায় এরা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। অথচ কল্পনা করতে পারেন, আমরা কত অকৃতজ্ঞ, সংকীর্ণ ও হীনমন্য- ভুলেও তাঁদের স্মরণ করার প্রয়োজন এবং গুরুত্ব বোধ করি না।
বিপ্লবী দলের তৎকালীন নেতারা মনে করতেন স্বভাবে দরদী ও কোমল মেয়েরা বিপ্লবী কাজে অনুপযুক্ত। ছেলেমেয়ে পাশাপাশি থাকলে ছেলেদের নৈতিক আদর্শ খারাপ হতে পারে। এই মনোভাবের বিরুদ্ধে কল্পনা দত্ত লিখেছেন। “ওঃ ধিং ধহ রৎড়হ ৎঁষব ভড়ৎ ঃযব ৎবাড়ষঁঃরড়হধৎরবং ঃযধঃ ঃযবু ংযড়ঁষফ শববঢ় ধষড়ড়ভ ভৎড়স ঃযব ড়িসবহ.”
সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে এই ওৎড়হ ৎঁষব-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন যারা, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। বোমা পিস্তল নিয়ে কাজ করার দৃষ্টান্ত তারা রেখে গেছেন।
১৯১৩ সালের ২৭শে জুলাই চট্টগ্রাম জেলার শ্রীপুর গ্রামে কল্পনা দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বিনোদবিহারী দত্ত ও মাতা শোভনবালা দত্ত।
কল্পনা দত্তের ঠাকুরদা ডাক্তার দুর্গাদাস দত্ত ছিলেন চট্টগ্রামের একজন বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি। ইংরেজ সরকার তার ব্যক্তিত্বকে সম্মান দিত। ফলে তাদের বাড়ি পুলিশের নজরের বাহিরে ছিল। শৈশব থেকেই কল্পনা মানসিক দিক থেকে ব্যতিক্রমী ছিলেন। অত্যন্ত ভাবপ্রবণ স্পর্শকাতর। ভিখারীকে ভিক্ষা করতে দেখলে তিনি ভীষণ দুঃখ পেতেন। দুঃখী মানুষের দুঃখের কাহিনী শুনে তিনি ব্যথিত হয়ে পড়তেন। শৈশবে তিনি কামনা করতেন সংসারে যেন দুঃখ না থাকে, সকলেই যেন সুখে দিন কাটাতে পারে।
কল্পনা দত্তের জীবন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা গেছে বারো বছর বয়স থেকেই তিনি স্বদেশী বই পড়তে আগ্রহী হন। বিপ্লবীদের জীবনী, ‘পথের দাবি’ এ ধরনের স্বদেশী বই পড়তে পড়তে তার মনে হতো ব্রিটিশ সরকারকে সরাতে পারলেই দেশ স্বাধীন হবে, দেশের দুঃখ দূর হবে। তার ছোট কাকা তাকে আদর্শ দেশ-সেবিকারূপে গড়ে ওঠার প্রেরণা দিতেন। তা থেকে ধীরে ধীরে দুঃসাহসিক কাজের দিকে তার প্রবণতা জাগে। তিনি ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দেবার জন্য মানসিক প্রস্ততি নিতে লাগলেন।
পড়াশুনায় মেধাবী বুদ্ধিদীপ্ত কল্পনা চট্টগ্রামের খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯২৯ সালে মেট্রিক পাশ করেন। এবং মেট্রিকে মেয়েদের মধ্যে ৪র্থ হন। তারপর চলে যান কলকাতায়। ভর্তি হন ঐতিহ্যসম্পন্ন বেথুন কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে। বেথুন কলেজে পড়ার সময়েই রাজনৈতিক জীবনই তার আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। বিপ্লবী হিসেবে নিজেকে তৈরি করার প্রবল আকাক্সক্ষা মনে জেগে ওঠে। স্বলারশিপের টাকায় সাইকেল কিনে সকালে সকলের ঘুম ভাঙ্গার আগেই বেথুন কলেজের কম্পাউন্ডের মধ্যে সাইকেলে ঘুরপাক খেতেন। প্রতি রবিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়েলে গিয়ে নৌকা চালানোর অভ্যাস করতেন। সূর্য সেনের ইন্ডিয়ান রিপাব্লিকান আর্মি দলের সদস্য হয়ে বিজ্ঞানের ছাত্রী কল্পনা নিজের পড়ার ঘরে বসে বোমার জন্য তৈরি করতেন গান-কটন।
তারপর তিনি যোগদান করেন কল্যাণী দাসের ‘ছাত্রী সঙ্ঘে’। তারপর বেথুন কলেজে হরতাল ও অন্যান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবী নেতা সূর্য সেনের অনুগামী পূর্ণেন্দু দস্তিতার কল্পনার মতন একজন বিপ্লবী মনস্কা নারীকে পেয়ে সর্বতোভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। এভাবেই বিপ্লবীদের সাথে তার যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন হয়। লুন্ঠন পরবর্তীকালে কল্পনা ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিপ্লবী কাজে সক্রিয় অংশগ্রহনের জন্য। চলে আসেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে এসে বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের মারফতে সূর্যসেনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯৩১ সালের মে মাসে কল্পনার সঙ্গে মাস্টারদার সাক্ষাৎ হয়।
ডিনামাইট ষড়যন্ত্রে কল্পনা দত্তের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। কলকাতা থেকে বোমা তৈরি করার মালমশলা সংগ্রহ করে চট্টগ্রামের বাড়িতে বসে গান কটন তৈরি করতে থাকেন। সেগুলো চলে যেত জেলের ভেতরে। চট্টগ্রামে জেলে অনন্ত সিং প্রমুখ বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ হতো কল্পনা দত্তের মাধ্যমে। দেখা যায় ১৯৩১ সালের ডিনামাইট ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগের দিনই পুলিশের নজরে আসে। তবে তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাকে সন্দেহ করে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের আদেশ দেয় সরকার। চট্টগ্রাম কলেজে গিয়ে বিএসসি পড়ার অনুমতি দেওয়া হয় কিন্তু অন্যত্র যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় অনেকদিন রাতে পালিয়ে গিয়ে গ্রামে চলে যেতেন এবং সূর্য সেন, নির্মল সেনের সঙ্গে দেখা করতেন। ইত্তবসরে রিভলভার চালাতেও অভ্যস্থ হন।
তারপর পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের জন্য কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ওপর দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন মাস্টারদা। প্রস্তুতির জন্য কল্পনাকে ডেকে পাঠান। যাবার পথে সে অঞ্চলটি একা মেয়ের পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় বলে কল্পনা পুরুষের বেশে মাস্টারদার সঙ্গে দেখা করতে রওয়ানা হন। এসবের প্রমাণ না পেয়ে পুলিশ জামিনে খালাস দেয়। মামলাটি ছিল ১০৯ ধারার ‘ভাগাবন্ড কেস’।
গোয়েন্দা বিভাগের সন্দেহ ছিল যে কল্পনা বিপ্লবীদের সংস্পর্শে এসেছে কিন্তু প্রমাণের অভাবে কিছু করতে পারছিল না। অন্যদিকে কলেজে যাওয়া আসা ছাড়া অন্য কোন সময় ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতি ছিল না।
ইতিমধ্যে চট্টগ্রামকে মিলিটারী এরিয়া বলে ঘোষণা করা হয়। প্রতি গ্রামেই ছিল মিলিটারী ক্যাম্প। আত্মগোপনে থাকা অত্যন্ত কঠিন কাজ। ১৯৩৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী মাস্টারদা ধরা পড়েন। কল্পনা পুলিসের ব্যুহ থেকে পালিয়ে আসেন। প্রতিনিয়ত স্থান পরিবর্তন করতে করতে কল্পনা দত্ত, তারকেশ^র দস্তিদার, মনোরঞ্জন দত্ত, মনোরঞ্জন দে এবং অর্ধেন্দু গুহ সমুদ্রের ধারে গাহিরা নামক গ্রামে আশ্রয় নেন। সেখানে কয়েকদিন আত্মগোপন করে থাকার পর ১৯৩৩ সালের ১৯শে মে ভোরে সেই গ্রামে রাতে মিলিটারী আক্রমণ করে। বিপ্লবীরাও গুলি চালায়। যুদ্ধ করতে করতে বিপ্লবী মনোরঞ্জন দত্ত নিহত হন। আশ্রয়দাতা পূর্ণ তালুকদারও নিহত হন এবং তার ভাই নিশি তালুকদার আহত হন। বিপ্লবীদের গুলি নিঃশেষ হয়ে যাবার পর সকলেই গ্রেফতার হন। মিলিটারি সুবেদার কল্পনা দত্তকে চপেটাঘাত করেন। কিন্তু মিলিটারী সৈনিকরা তৎক্ষণাৎ তার প্রতিবাদ করেন। বিপ্লবী তারকেশ^র দস্তিদারের চোখে লোহার কাটাওয়ালা মিলিটারী বুট দিয়ে এমন লাথি মারে যে তার চোখ দিয়ে রক্তের ধারা পড়তে থাকে। তার ওপর রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাবার সময় হান্টার দিয়ে মারতে থাকে। কল্পনা দত্তকেও হাতকড়া দিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যায়।
এই মামলার নাম ছিল ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন সেকেন্ড সাপ্লিমেন্টারী কেস’। এর চার্জ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ, ষড়যন্ত্র, বিস্ফোরক আইন, অস্ত্র আইন হত্যা প্রভৃতি। এই মামলার আসামি ছিলেন সূর্য সেন, তারকেশ^র দস্তিদার এবং কল্পনা দত্ত। মামলার রায়ে সূর্য সেন ও তারকেশ^রের ফাঁসির আদেশ হয় এবং কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন দীপান্তরের আদেশ হয়। অনেক চেষ্টার পর সেই দীপান্তরের আদেশ স্থগিত হয়। মামলার রায়ে স্পেশাল ট্রাইবুনাল জজ বলেন, ‘মেয়ে বলে এবং বয়স কম বলেই কল্পনা দত্তকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা গেল না।’
‘দেশের মানুষ আমাদের জেলে রেখে নিশ্চিন্তে থাকবে না, আমাদের বের করে নিয়ে যাবেই’-এই বদ্ধমূল ধারণা ছিল কল্পনার। ফেলে রাখা অসমাপ্ত কাজ আবার হাতে তুলে নিত হবে।
শাস্তি পাওয়ার পরেই কলকাতা হিজলি স্পেশাল জেলে কল্পনাকে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই ডিভিশনের বন্দী ও অন্যান্য মেয়ে ডেটিনিউদের সঙ্গে থাকবার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনমাস সেখানে ছিলেন। বইপত্র পড়ার সুযোগ থাকলেও পড়েননি কিছু। অন্য জেলে স্থানান্তরিত করে নেওয়া হয়।
তিন চার বছর পরে সমস্ত মেয়ে রাজবন্দীদের একত্রে রাখার ব্যবস্থা হয়। তাদের অনেকে ডেটিনিউদের সঙ্গে থাকার ফলে বহির্জগৎ সম্পর্কে কিছু সংবাদ তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। ‘পরিচয়’ মাসিক পত্রিকা পড়ার সুযোগ হয়। কমিউনিষ্টদের সম্পর্কে তাঁদের কাছ থেকে কিছু কিছু শুনতেন, জায়াড-এর লেখা, কোলের লেখা বার্নান্ড শ-এর সোসালিজম, কমিউনিজম সম্বন্ধে কিছু কিছু বইও তাদের কাছ থেকে পেলেন। বইগুলোর যুক্তিতর্ক মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয় কল্পনাকে। এতদিনকার পড়া বিপ্লবী সাহিত্যাভাবের উন্মাদনা জাগিয়ে তুলেছিল, তীব্র অনুভূতি মরণকে তুচ্ছ করতে শিখেছিলেন। ‘সমাজতন্ত্রবাদ ও সাম্যবাদ’ সম্বন্ধে এইসব বইয়ের যুক্তিতর্ককে অস্বীকার করা যায় না।
কমিউনিজমের সঙ্গে বিপ্লবীদের মতের কোন অমিল নেই। কেউ কেউ যখন বলত টেররিস্টদের কমিউনিষ্টরা শত্রু বলে মনে করে হেসে উড়িয়ে দিতেন কল্পনা। দু’দলের আদর্শ যখন স্বাধীনতা-তখন পার্থক্য কোথায়? তিনি বিশ^াস করতেন কমিউনিস্টরা অনেক বেশি শিক্ষিত, পড়াশুনা করে জানে অনেক বেশি।
রম্যা রল্যার ‘আই উইল নট রেস্ট’ বইটি পড়ে রাশিয়ার বিপ্লবের প্রতি শ্রদ্ধা জেগেছিল শুধু তাই না, লিখেছেন ‘লেনিনকে পূজা করতে আরম্ভ করলাম। তার আগে রম্যাঁ রল্যার লেখা সোল এনচান্টেড ও ‘জা ক্রিস্তোফ’ বই দু’টি পড়ে ওনার লেখার প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন।
১৯৩৭ সালে প্রদেশে প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বিনা বিচারে রাজবন্দীদের ছেড়ে দেওয়া,রাজনৈতিক বন্দীদের আন্দামান থেকে নিয়ে আসা এবং তাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য বাইরে জনসাধারণের তুমুল আন্দোলন হয়। বন্দীদের আন্দামান থেকে ফিরিয়ে আনা হয় ১৯৩৭-এর নভেম্বর মাসে। ১৯৩৮-এর প্রথম দিকে কল্পনার বাবা জেলে এলেন মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে। এসে শুনলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অগ্নিকন্যা কল্পনার মুক্তির আবেদন জানিয়ে গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। কল্পনার বাবাকে লেখা একটি চিঠি দেখালেন ‘তোমার মেয়ের জন্যে যা যা আমার করার সাধ্য তা করেছি। তার শেষ ফল জানবার সময় এখনো হয়নি, আশা করি চেষ্টা ব্যর্থ হবে না।’
রবীন্দ্রনাথের বন্ধু সিএফ এভরুজও কল্পনাকে জেল থেকে বের করার জন্য অপরিসীম পরিশ্রম ও আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গভর্ণরের কাছেও গিয়েছিলেন এবং কল্পনার বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন ‘কল্পনা যেদিন মুক্তি পাবে সেদিন যেন তাকে টেলিগ্রাম করা হয়।’
গান্ধীজি কল্পনার বাবাকে বলেছিলেন, সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে চেষ্টা করবেন। তবে ১৯৩৯ সালের ১লা মে ছাত্র আন্দোলনের চাপে সরকার কল্পনা দত্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। জেল গেটে এলেন কল্পনার বাবা এবং মাসতুতো ভাই ঝুমকু (সুবোধ রায়)। তিনি বছর খানেক আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। তিনিও ছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের আসামী।
কারাবাস থেকে মুক্ত হবার সাতদিন পরেই কল্পনা চলে আসেন চট্টগ্রামে। কমিউনিষ্টদের সঙ্গেই কাজ করেন। সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে কুলিদের পড়াতেন, মালিপাড়া, ধোপাপাড়ায় গিয়ে গোপন সভা করতেন। তিনি জানতে পারেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে হলে কোনও একটি গণ-সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। তার মধ্য দিয়েই তাকে যাচাই করে নেওয়া হবে।
অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কল্পনা উপলব্দি করেন কমিউনিস্ট পার্টিতে নৈতিক শিথিলতার স্থান নেই। আত্মসর্বস্ব ও স্বার্থপরদের কমিউনিস্ট পার্টিতে জায়গা হয় না। নিজেকে সংশোধন যারা করতে পারে তারা থাকে-সংশোধন করবার প্রচুর সুযোগ তাদের দেওয়া হয়। যারা পারে না বা সংশোধন করে না, তাদের পার্টি থেকে বে করে দেওয়া হয়। এই সত্যও উপলব্দি করলেন সাম্যবাদই প্রকৃত দেশপ্রেম এবং সেই দেশপ্রেম মানে আত্মবিশ^াস জাগিয়ে তোলা।
১৯৪০ সালে কলকাতায় চলে যান বিএ পরীক্ষা দিতে। জুলাই মাসে বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হন। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কল্পনাকে কলকাতা থেকে বহিস্কার করে অন্তরীনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রামে। ঐ সময় কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল।
১৯৪১ সালে চট্টগ্রামে জাপানী আক্রমণের আশঙ্কায় জাপবিরোধী প্রচারকাজে অংশগ্রহন করেন কল্পনা। ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের সৃষ্ট ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ যা ’পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত, ফলে সারা বাংলায় ৫০ লক্ষ ও চট্টগ্রামে ২লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। কল্পনার নেতৃত্বে মহিলা সমিতি কাহার সম্প্রদায়ের বিপর্যস্ত মানুষদের সংগঠিত করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মণিকুন্তলা চৌধুরী, জ্যোতি দেবী, পুস্প সেন, আরতি দত্ত, প্রগতি দস্তিদার, প্রভা দত্ত এবং শ্রীমতি এ কে খান প্রমুখ। নিরন্ন ক্ষুধাতুর মানুষদের সেবায় মহিলা সমিতির ভূমিকা ছিল স্মরণীয়।
১৯৪৩ সাল কল্পনা দত্তের জীবনে স্মরণীয়। এই বছরেই কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করেন। বছরের শেষে বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে। সেখানেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পূরণচাঁদ যোশীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শেষ হবার আগে, দেশী-বিদশী উচ্ছৃঙ্খল সেনাদল চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার কাছাড়পাড়া গ্রামের মুসলিম পাড়ায় আকস্মিক আক্রমণ করে এবং ব্যাপক হারে নারীদের ধর্ষণ করে। সংবাদ পাওয়ামাত্র কল্পনা ছুটে যান এবং পার্টির জেলা সম্পাদকমন্ডলীর সাহায্যে এক্যবদ্ধ কর্মসূচী গ্রহণ করেন-কংগ্রেস, মুসলীম লীগ, বিভিন্ন বামপন্থী দল ও বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে। সাতদিন হরতাল পালন করা হয়। অবশেষে ব্রিটিশ সরকার ও সেনাবাহিনী পিছু হটে।
১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম মহিলা আসনে কল্পনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হয়ে, কংগ্রেস প্রার্থী দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহনের স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তার বিরুদ্ধে। নির্বাচনী সমাবেশে জনগণের ব্যাপক উপস্থিতি দেখে কংগ্রেস ভয় পেয়ে যায় এবং খোদ জহরলাল নেহেরুকে নির্বাচনী প্রচারে আসতে হয়েছিল। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধিতা করেছিলেন কিন্তু কল্পনার বিরুদ্ধে কোন আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেননি। উপরন্তু ‘বাহাদুর লাড়কী’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
নির্বাচনে কল্পনা জয়লাভ করেননি সেই সময় ভোটাধিকার ছিল সীমিত জনগনের। খেটে খাওয়া গরিব নি¤œবর্ণের মানুষদের ভোটাধিকার ছিল না।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হয়ে যায। জন্মভূমি ছেড়ে চলে যান ভারতে। কমিউনিস্ট পার্টির কাজে নিজেকে যুক্ত করে নেন। সক্রিয়ভাবে যুক্ত হলেন ভারত-সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সামতির প্রতিদিনের কাজে। রুশ ভাষার শিক্ষিকা হিসেবে নাম করেছিলেন। তিনি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের তথ্য সংগ্রাহক হিসেবে যোগদার করেন এবং যোগ্যতার সঙ্গে সেই ভূমিকাও পালন করেছেন।
দেশভাগের পর স্বাধীন বাংলাদেশে এসেছিলেন দু’বার ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে। শেষবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে এসেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন সমব্যথী।
ইংরেজী ও বাংলা ভাষায় সমান দক্ষতা ছিল কল্পনার। চল্লিশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র ‘পিপলস ওয়ার’ পত্রিকায় নিয়মিতভাবে এবং প্রাকশিত তৎকালীন সামাজিক বিষয়ের ওপর তাঁর লেখাগুলো গবেষকদের কাছে মূল্যবান দলিল হয়ে আছে। ১৯৪৫-এ ‘চিটাগাং আর্মারি রেইডার্স রেমিনিসেন্স’ প্রকাশিত হয় বোম্বাই থেকে। ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত তার অবিস্মরণীয় গ্রন্থটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে পরিচিত। ১৯৯০ সালে ‘চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান’ নামে ভারত সরকারের উদ্যাগে আর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম যুব আন্দোলনের ইতিহাস লিতে শুরু করেছিলেন শেষ করতে পারেননি। আরও একটি মনোবেদনা নিয়ে চলে গেছেন তার জীবনের স্মৃতিকথার তিন হাজার পৃষ্টার পান্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছিলেন। দিল্লীতে অটোরিক্সায় ভুল করে ফেলে গেছেন ফিরে পাননি।
১৯৯৫-এর ৮ই ফেব্রুয়ারী কলকাতার শেঠ সুখলাল কারনানী মেমোরিয়াল হাসপাতালে কল্পনা দত্ত যোশীর ৮২ বছর বয়সে জীবনাবসান হয়। তিনি ছিলেন আমৃত্যু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে কল্পনা দত্ত যোশী একটি চিরস্মরণীয় নাম। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চির জাগরুক হয়ে আছেন এবং থাকবেন।
লেখক: সভপতি- যুক্তরাষ্ট্র উদীচী।