মতবিনিময় সভায় নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ইংরেজি দৈনিক নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেছেন, বাংলাদেশ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকট এই অর্থে যে, দেশের বর্তমান সরকার প্রতিদিন যে উন্নয়নের কথা বলছে, এটা অর্ধসত্য। অর্ধসত্য কখনো কখনো মিথ্যার চেয়েও খারাপ। এটা সত্য দেশে কিছু স্ট্র্যাচার তৈরি হয়েছে। এটাকে সরকার উন্নয়ন বলে চালিয়ে যাচ্ছে।
একটা দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে সেই দেশের মানুষের জীবনমান কত পার্সেন্ট বাড়লো তার ওপরে এবং তার সাংবিধানিক অধিকার কতটুকু ভোগ করলো তার ওপরে।
গত রোবাবার নিউইয়র্কে এক অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন নূরুল কবির। এতে উপস্থিত ছিলেন মূলধারার রাজনীতিক গিয়াস আহমেদ, কমিউনিটি এক্টিভিস্ট খন্দকার ফরহাদ, সাংবাদিক মুনির হায়দার প্রমুখ।
নূরুর কবির বলেন, সব পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে, অন্যদিকে একশ্রেণি অর্থবিত্তে আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। মানুষের কস্ট অব লিভিং বেড়ে গেছে, এই সরকার ক্ষমতায় আসার সময় যা ছিল, এখন তার চেয়ে খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছে। এটা এখন সরকারও স্বীকার করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে যারা ফিক্সড ইনকামের মানুষ, তাদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। কারণ প্রতিদিন প্রকৃত মজুরি কমে যাচ্ছে। প্রকৃত মজুরি যখন কমে যায়, তখন তার প্রয়োজনগুলোও কমে। এটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ গত ১৪ বছরে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ নিয়েছে এবং সেই ঋণের ভিত্তিতে এসব উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। এর দুটি দিক রয়েছে, যে কাজ পাঁচ ডলারে করা যেত, যা আমাদের আশপাশের দেশগুলোতে করা হচ্ছে-সেটা আমাদের দেশে করা হয় ৭ থেকে ১০ ডলারে। এসব কাজে প্রচন্ড দুর্নীতি হয়েছে। এই অর্থ দেশের মানুষকে দিতে হবে। একদিকে বিদেশি ঋণ, অন্যদিকে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আর কিছুদিনের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারবে উন্নয়নের নামে ডিজাস্টার হয়েছে। রাজনৈতিক সংকট আরো বেশি ঘনীভূত হয়েছে। আপনারা জানেন, বাংলাদেশের মানুষ কথা বলতে ভালোবাসে, নির্বাচন করতে চায়। আগে পত্রপত্রিকায় নির্বাচন নিয়ে লেখা হতো উৎসবমুখর পরিবেশ। বাংলাদেশের নির্বাচনে এখন সেই পরিবেশ নেই। ভোটাধিকার গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ। আজকে এতো বছর পর আমাদের ভোটাধিকারের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠা করতে হলে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান লাগে। তার মধ্যে কোর্ট সবচেয়ে বড়। বাংলাদেশের কোর্ট ব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে-এটা এখন বাংলাদেশের কোনো মানুষকে বোঝানোর দরকার পড়ে না।
নূরুল কবীর বলেন, একটি দেশের অগ্রগতি নির্ভর করে সেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার যে মান কমেছে এটা শত শত অধ্যাপক শিকার করেন। বাংলাদেশের সব আন্দোলনের সূত্রপাত হতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বা উপাচার্য যখন পত্রিকা বন্ধ করার জন্য মিছিল করে কিংবা মানববন্ধন করে-এর মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারে, এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা কোথায়? যেটা বিকাশ হওয়ার কথা, সেটা কত পিছিয়ে যাচ্ছে। নতুনভাবে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার মান, কারিকুলাম উন্নত করা না হয় এবং সেই অনুযায়ী দীক্ষা দেওয়া না হয়, তাহলে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা ভারত, পাকিস্তান, নেপালের ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে পিছিয়ে যাবে। নানানভাবে আমরা পিছিয়ে পড়ছি বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের দিক থেকে, রাজনৈতিক দিক থেকে, গণতন্ত্রের বিকাশের প্রশ্নে এবং অর্থনৈতিভাবে আমরা একটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছি। এই তিনটি চ্যালেঞ্জকে আমরা যদি মোকাবিলা করতে চাই-সেটা কী ধরনের গবেষণা লাগবে, বিকল্প ব্যবস্থাগুলো কী, সেটা একাডেমিক লেবেলে কিছু কিছু কাজ হয়, কিছু কিছু পত্রপত্রিকায় বিচ্ছিন্নভাবে লেখা হয়। কিন্তু যারা বিরোধী দলে আছেন তারা এই সরকারের আমলে নানাভাবে নিপীড়ন এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে দুর্ভাবনার বিষয়টি হচ্ছে, এই সরকারের পতন ঘটলেও যে জায়গাগুলোতে বিপর্যয় ঘটেছে, সেগুলোকে মোকাবিলা পরিকল্পনা বিরোধীদলের কী, সেটা আমরা জানি না। বামপন্থীদের কিছু পরিকল্পনা আছে কিন্তু বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতের সেই পরিকল্পনা আমরা দেখিনি। একদিক থেকে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পদত্যাগে যে ন্যায্যতা আছে তেমনিভাবে সবার দুর্ভাবনার দিক থেকে যায়। যেমন এক পার্টি গেল, আরেক পার্টি এলো- কিছু প্রতিশোধ হলো, কিন্তু সাধারণভাবে জনগণের গণতন্ত্রায়ণ, মানুষের ক্ষমতায়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কীভাবে হবে বা উত্তরণের উপায় কী তা আমরা বিরোধীদের কাছ থেকে এখনো পাইনি।